বর্তমানে ফেসবুক শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি ব্যবসা এবং ব্র্যান্ডের জন্য একটি শক্তিশালী ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। DataReportal-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশে ফেসবুকের ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ৬ কোটি, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.৩ শতাংশ বেশি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬ কোটি ৭১ লাখের বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ (Facebook)। এত বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারীর উপস্থিতি ফেসবুককে একটি অত্যন্ত কার্যকর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
তবে শুধু একটি পেজ থাকলেই হবে না, অর্গানিক রিচ এখন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। TekRevol-এর গবেষণা বলছে, একটি ফেসবুক পেজ তার ফলোয়ারদের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশের বাইরে থাকা দর্শকের কাছে সাধারণ পোস্টের মাধ্যমে পৌঁছাতে পারে। এ কারণেই পেশাদারভাবে তৈরি এবং সঠিকভাবে অপ্টিমাইজ করা একটি পেজের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।
একই সঙ্গে, বাংলাদেশে ফেসবুক বিজ্ঞাপন তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী, যেখানে ব্র্যান্ড পরিচিতি বাড়ানোর জন্য প্রতি ক্লিকের গড় খরচ প্রায় ৫ থেকে ২০ টাকা হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, একটি অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ তৈরি করা এবং তা ভালোভাবে পরিচালনা করা এখন যেকোনো ব্যবসার জন্য একটি কৌশলগত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফেসবুক পেজ তৈরি করার ১০টি সহজ ধাপ
ফেসবুক পেজ তৈরি করা একটি সহজ কাজ। তবে প্রতিটি ধাপে যদি সঠিক তথ্য দিয়ে পেজটি তৈরি করা যায়, তাহলে তা আপনার ব্যবসার জন্য একটি কার্যকর অনলাইন মাধ্যম হয়ে উঠবে। নিচে পেজ তৈরির ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হলো।
ধাপ ১ঃ আপনার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লগইন করুন

ফেসবুক পেজ পরিচালনার জন্য একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি। তাই প্রথমেই আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লগইন করুন।
ধাপ ২ঃ নতুন পেজ তৈরি করুন

ফেসবুক মেনুর বাম পাশে থাকা ‘Pages’ অপশনে যান। সেখান থেকে ‘Create a New Page’ বোতামে ক্লিক করে নতুন পেজ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করুন।

ধাপ ৩ঃ পেজের মৌলিক তথ্য দিন

এই ধাপে আপনাকে পেজের নাম, ক্যাটাগরি এবং বিবরণ যুক্ত করতে হবে।
- পেজের নামঃ আপনার পেজের নাম হবে আপনার ব্র্যান্ডের পরিচয়। এমন নাম বেছে নিন যা সহজ, মনে রাখা যায় এবং আপনার ব্যবসার সঙ্গে মানানসই। নামটি যেন অন্য কোনো ব্র্যান্ডের সঙ্গে মিলে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- ক্যাটাগরিঃ আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ড কোন ধরনের, তা বোঝাতে সর্বোচ্চ তিনটি ক্যাটাগরি বেছে নিন। সঠিক ক্যাটাগরি নির্বাচন করলে সঠিক গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সহজ হয় এবং আপনার পেজের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
- বিবরণ (Description)ঃ পেজের বিবরণ বা ‘About’ অংশে আপনার ব্যবসা কী করে এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, তা সংক্ষেপে তুলে ধরুন। বর্ণনাটি আকর্ষণীয় এবং স্পষ্ট হতে হবে।
ধাপ ৪ঃ ‘Create Page’ বোতামে ক্লিক করুন

ওপরের সব তথ্য সঠিকভাবে পূরণ করার পর ‘Create Page’ বোতামে ক্লিক করুন। আপনার পেজ এখন তৈরি হয়ে যাবে।
ধাপ ৫ঃ অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত করুন

আপনার ব্যবসার যোগাযোগের তথ্য যেমনঃ ফোন নম্বর, ইমেইল ঠিকানা, ওয়েবসাইট লিংক এবং অফিসের ঠিকানা (যদি থাকে) এখানে যোগ করুন।

গ্রাহকের সুবিধার জন্য আপনার ব্যবসার সময়সূচিও এখানে দিতে পারেন।
ধাপ ৬ঃ প্রোফাইল ও কভার ছবি আপলোড করুন

একটি ফেসবুক পেজের প্রথম পরিচয় হলো এর ছবি। তাই প্রোফাইল ও কভার ছবি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যত্নশীল হন।
প্রোফাইল ছবিঃ এখানে আপনার ব্যবসার লোগো ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো। একটি পেশাদার লোগো ব্যবহার করুন যা ছোট স্ক্রিনেও সহজে বোঝা যায়।
কভার ছবিঃ কভার ছবিতে এমন ছবি ব্যবহার করুন যা আপনার ব্যবসার ধরন এবং মূল বার্তা প্রকাশ করে। যেমন, রেস্টুরেন্টের জন্য খাবারের ছবি, ফিটনেস সেন্টারের জন্য ব্যায়ামের ছবি এবং ই-কমার্স ব্যবসার জন্য পণ্যের ছবি ব্যবহার করতে পারেন।
ধাপ ৭ঃ ‘কল-টু-অ্যাকশন’ বোতাম সেট করুন
‘কল-টু-অ্যাকশন’ বা CTA বোতাম আপনার পেজের দর্শকদের নির্দিষ্ট একটি কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে। উদাহরণ হিসেবে, যদি আপনি একটি অনলাইন শপ চালান, তাহলে ‘Shop Now’ বোতাম ব্যবহার করুন। যদি কোনো সেবা প্রদান করেন, তবে ‘Contact Us’ বা ‘Book Now’ বোতাম সেট করতে পারেন।
ধাপ ৮ঃ হোয়াটসঅ্যাপ বিজনেস অ্যাকাউন্ট যোগ করুন (ঐচ্ছিক)

যদি আপনি গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে চান, তাহলে আপনার ব্যবসার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টটি পেজের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। এটি গ্রাহক সেবা, অর্ডার নেওয়া বা বিভিন্ন তথ্যের জন্য একটি সরাসরি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
ধাপ ৯ঃ বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানান

পেজে প্রথম ফলোয়ার বা দর্শক পেতে আপনার ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে বন্ধু এবং পরিচিতদের পেজে লাইক দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
ধাপ ১০ঃ কন্টেন্ট দেওয়া শুরু করুন

পেজ তৈরি করার পর সবচেয়ে জরুরি হলো নিয়মিত মানসম্মত কন্টেন্ট শেয়ার করা। শুধু ছবি বা ভিডিও নয়, এমন পোস্ট তৈরি করুন যা দর্শকদের আগ্রহী করে এবং আপনার ব্যবসার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করে।
কেন আপনার ব্যবসার জন্য একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থাকা জরুরি?
অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থাকা মানে আপনি আপনার ব্যবসাকে পেশাদারভাবে উপস্থাপন করছেন, যা গ্রাহকের বিশ্বাস জয় করার প্রথম ধাপ। অনেক নতুন গ্রাহকই কোনো ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার জন্য সবার আগে তাদের ফেসবুক পেজটি দেখেন।
ফেসবুক পেজ থাকার আরেকটি বড় সুবিধা হলো, এটি আপনার ব্যবসাকে নতুন গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করে। পেজে নিয়মিত পোস্ট, আকর্ষণীয় অফার এবং ইভেন্টের তথ্য দিলে তা সহজে মানুষের নজরে আসে এবং আপনার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ তৈরি করে। এছাড়াও, কল-টু-অ্যাকশন বোতাম, হোয়াটসঅ্যাপ (WhatsApp) সংযোগ এবং সরাসরি মেসেজিং সুবিধা গ্রাহকের সঙ্গে আপনার যোগাযোগকে আরও সহজ করে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন কেউ একটি নতুন রেস্টুরেন্ট খুঁজছেন। তিনি সাধারণত পেজের রিভিউগুলো পড়েন এবং খাবারের ছবি বা পোস্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেন। একটি সুন্দরভাবে সাজানো ও সক্রিয় পেজ ভিজিটরদের মনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে এবং তারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বা আপনার সেবা নিতে আগ্রহী হন।
ফেসবুক পেজ সফলভাবে পরিচালনার ৬টি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল

একটি ফেসবুক পেজ তৈরি করার পর সেটিকে কার্যকরভাবে চালানোর জন্য নির্দিষ্ট কৌশল জানা জরুরি। নিচে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলোঃ
১. ভিডিও এবং রিলসের ব্যবহার বাড়ান
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সাধারণ পোস্টের চেয়ে ভিডিও এবং রিলস অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং দর্শক এগুলো দেখতে বেশি সময় ব্যয় করেন। যেমন, একটি পোশাকের দোকান যদি “আজকের রিলস অফার” নামে ছোট ভিডিও তৈরি করে, তবে তা সাধারণ ছবির পোস্টের চেয়ে বহুগুণ বেশি রিচ পেতে পারে।
২. ট্রেন্ড বা জনপ্রিয় বিষয়গুলো কাজে লাগান
সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন নতুন ট্রেন্ড, বিশেষ করে বাংলায় তৈরি মিম (meme), টিকটক রিলসের ট্রেন্ড, সোশ্যাল চ্যালেঞ্জ অথবা জনপ্রিয় গান ব্যবহার করলে সেই কন্টেন্টগুলো খুব দ্রুত ভাইরাল হয়। আপনার ব্যবসার সঙ্গে মানানসই ট্রেন্ড দেখে দ্রুত কন্টেন্ট তৈরি করলে আপনার রিচ দ্রুত বাড়বে।
৩. পেইড বিজ্ঞাপন ও রি-টার্গেটিং করুন
শুধুমাত্র সাধারণ পোস্ট বা অর্গানিক রিচের ওপর নির্ভর করা কঠিন। তাই বিজ্ঞাপনের জন্য একটি ছোট বাজেট রাখুন। বিশেষ করে যখন নতুন পণ্য আনবেন বা কোনো বিশেষ ছাড় (সেল অফার) দেবেন, তখন পেইড বিজ্ঞাপন ব্যবহার করুন। যারা একবার আপনার পেজ দেখেছে বা ওয়েবসাইট ভিজিট করেছে, তাদের কাছে রি-টার্গেটিং বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে বিক্রির জন্য উৎসাহিত করুন।
৪. কমেন্ট ও মেসেজে দ্রুত সাড়া দিন
গ্রাহক বা ফলোয়ার যদি কোনো কমেন্ট করেন বা প্রশ্ন করেন, তবে তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিন। এর জন্য পেজের অ্যাডমিনকে প্রতিদিন মেসেজ ও কমেন্ট মনিটর করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি রেস্টুরেন্ট পেজে অর্ডারের বিষয়ে করা প্রশ্নের উত্তর ৫০ মিনিট পরে দেওয়ায় সেই অর্ডারটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই দ্রুত উত্তর দিলে গ্রাহকের আস্থা বাড়ে এবং বিক্রিও বাড়ে।
৫. ছোট বাজেটে ক্যাম্পেইন পরীক্ষা করুন
ছোট ছোট বাজেটে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চালিয়ে দেখুন, কোন ধরনের কন্টেন্ট (ভিডিও, ছবি, রিলস, লেখা) বেশি কার্যকর হচ্ছে এবং কোন সময়ে পোস্ট করলে সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া যায়। যেমন, বিকেলে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে ফেসবুক লাইভ করলে সাধারণ পোস্টের চেয়ে বেশি দর্শক পেতে পারেন।
৬. লোকাল কন্টেন্ট ও বাংলা ভাষা ব্যবহার করুন
গ্রাহকের মন জয় করতে হলে তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করা জরুরি। ইংরেজীর বদলে পরিমার্জিত বাংলা ব্যবহার করে পোস্ট করলে এনগেজমেন্ট বাড়ে। স্থানীয় উৎসব, ঘটনা বা বাংলার জনপ্রিয় কোনো বিষয় নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করলে গ্রাহকদের কাছ থেকে আরও বেশি সাড়া পাওয়া যায়।